সন্তানদের করেছেন প্রতিষ্ঠিত। লিখে দিয়েছেন ফ্ল্যাট-বাড়ি। তারপর বাবা একটা সময় বুঝতে পারেন যে, সন্তানদের ঘরে তিনি ‘জঞ্জাল’ হয়ে উঠছেন। এক পর্যায়ে ধুঁকে ধুঁকে সেই বাবা মারা যান আর তার সন্তানেরা তার দাফন করতেও অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন!
আমাদের দেশে ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনার একটি সত্য গল্প সবার সাথে শেয়ার করেছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। সোমবার রাত ১০টায় তিনি তার ফেসবুকে এমনই এক মর্মান্তিক সত্য ঘটনা ‘একটি সত্য ঘটনা, সবাইকে পড়ার অনুরোধ রইলো’ শিরোনামে লিখেন।
মোহাম্মদ সাহেদ-এর সেই স্ট্যাটাসটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো –
‘লোকটির নাম হামিদ সরকার। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। আমার সাথে তার পরিচয় সূত্রটা পরেই বলছি।
আমি যখন উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রথম শাখা উদ্বোধন করি, তখন উত্তরা পশ্চিম থানার তৎকালীন ওসি এবং মসজিদের ইমাম সাহেব আমার কাছে আসেন। তারা বললেন যে, একজন লোক অনেকদিন ধরে মসজিদের বাইরে পড়ে আছে। অনেকে ভিক্ষুক ভেবে তাকে দু-চার টাকা ভিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
ইমাম সাহেব তার জন্য প্রেরিত খাবার থেকে কিছু অংশ লোকটিকে দিয়ে আসছেন প্রতিদিন। হঠাৎ লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা আমার সরনাপন্ন হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি লোকটিকে আমার হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি এবং দায়িত্বরত ডাক্তার ও অন্যান্য সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীকে অবগত করি যে, এই লোকটির চিকিৎসার সকল দায়ভার আমার ও এর চিকিৎসায় যেন কোন ত্রুটি না হয়।
হামিদ সরকার নামক লোকটির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমি রীতিমত অবাক হলাম। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জোনাল সেটেলম্যান্ট অফিসার। তার তিন ছেলের মধ্যে তিন জনই বিত্তশালী। উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে তার নিজস্ব বাড়ি আছে যা ছেলেদের নামে দিয়েছেন। তার বড় ছেলে ডাক্তার। নিজস্ব ফ্ল্যাটে স্ত্রী, শালী এবং শ্বাশুড়ী নিয়ে থাকেন, অথচ বৃদ্ধ বাবার জায়গা নেই।
মেঝ ছেলে ব্যবসায়ী, তারও নিজস্ব বিশাল ফ্ল্যাট আছে। যেখানে প্রায়ই বাইরের ব্যবসায়ীক অতিথীদের নিয়ে পার্টি হয়। অথচ বাবা না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ছোট ছেলেও অবস্থাসম্পন্ন। কিন্তু স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য বাবাকে নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে পারে না। সকল সন্তান স্বাবলম্বী হওয়া স্বত্তেও বাবার স্থান হয়েছে শেষে মসজিদের বারান্দায়। সেখান থেকে আমার হাসপাতালে।
প্রসঙ্গত, আমার হাসপাতালে আগত রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের প্রয়োজন হলে আমি রক্ত দেবার চেষ্টা করি। সেদিনও হামিদ সরকার নামক অসুস্থ লোকটিকে আমি রক্ত দিয়েছিলাম। অবাক করা বিষয় হলো, তিনি দিন ১৫ আমার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, অথচ কোন একটা ছেলে পনের মিনিটের জন্যও তার খোঁজ নেয়নি।
আরও দুঃখজনক হলো, সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও পনের দিন পরে আরো একটা কার্ডিয়াক অ্যাটাকে হামিদ সাহেব মারা যান। তার মৃত্যুর পরে আমি তার বড় ছেলেকে ফোন করি। তিনি আমাকে প্রতি উত্তরে জানান যে, তিনি জরুরী মিটিংয়ে আছেন এবং লাশটি যেন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম এ দিয়ে দেওয়া হয়। পরে কোন আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আমি নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে তার লাশ যথাযথ মর্যাদায় দাফন করি।
লেখাটি আমি কোন প্রকার বাহবা নেওয়ার জন্য লিখিনি। আজ আমি নিজেও একজন বাবা। সন্তানের একটু সুখের জন্য দিনরাত একাকার করছি। সেই সন্তান যদি কোনদিন এধরনের আচরন করে তখন আমার কেমন লাগবে, শুধু এই অনুভূতি থেকে লেখা।
আমার মনে একটা প্রশ্ন, আমরা যারা বাবা-মাকে অসম্মান, অবহেলা করি তারা কি একবারও ভেবে দেখি না যে, একদিন ওই জায়গাটাতে আমরা নিজেরা গিয়ে দাঁড়াব।
আজ আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে যে আচরণ করছি, তা যদি সেদিন আমার সন্তান আমার সাথে করে তবে? আজ আমাদের বাবা-মায়েরা সহ্য করছে। কাল আমরা কি সহ্য করতে পারব?’
No comments: