রাজনীতি: স্পর্শকাতর যশোর-৩ : আসন রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে আ'লীগ-বিএনপি !!
যশোরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন যশোর-৩ (সদর)। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। সে কারণে আসনটি দখলে রাখা প্রধান দু'দলের কাছেই বড় চ্যালেঞ্জ। গত পাঁচ মেয়াদের চারবারই এ আসন থেকেছে আওয়ামী লীগের কাছে। ফলে আগামী নির্বাচনে 'নৌকা'র বিজয়ের এই ধারা অক্ষুণ্ন রাখাটা তাদের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু। তবে দলের অন্তর্কলহ ও প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল হলে 'চরম খেসারত' দিতে হতে পারে। অন্যদিকে বিএনপিতে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি এক প্রকার চূড়ান্ত হলেও দলটির নেতা-কর্মীরা চিন্তিত ভোটের মাঠে নির্বিঘ্নে নামতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যশোর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাজী নাবিল আহমেদ। দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন চাকলাদার দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তির লড়াইয়ে এবার তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। এ আসনে মনোনয়ন চান নাবিলের ঘনিষ্ঠ অনুসারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনও। এ ছাড়া ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে এসে 'নৌকা' প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হওয়া সাবেক সাংসদ খালেদুর রহমান টিটোও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে তিনি দলীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।
এ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রবীণ রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম। বর্ষীয়ান এই নেতা এবারও নির্বাচন করবেন এমন বিশ্বাস স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। তবে অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি প্রার্থী হতে না চাইলে তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন তার ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তবে অমিত বলেন, যতদিন বাবা আছেন ততদিন এ আসনে নিজে প্রার্থী হওয়ার কথা চিন্তাও করি না। আমি চাই, তিনিই নির্বাচন করবেন। মনোনয়নের জন্য দল আমাকে যোগ্য মনে করলে সেটা হবে আমার জন্য বিরাট পাওয়া।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, দলের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবেন। বিএনপির সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা চায় দক্ষিণবঙ্গে বিএনপির অভিভাবক তরিকুল ইসলাম এবারও নির্বাচন করবেন। তবে যদি তিনি করতে না চান, তাহলে তার সবচেয়ে আস্থাভাজন কর্মী হিসেবে তরিকুল ইসলাম আমাকেই পছন্দ করবেন বলে বিশ্বাস করি।
দীর্ঘ ১০ বছর পর নির্বাচনের মাঠে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। যশোরে দলটির সদস্য সংগ্রহ অভিযান উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশেও নির্বাচন ও আন্দোলনের জন্য কর্মীদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-আগ্রহের কমতি নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের ফলও বিএনপি জোটের অনুকূলে থাকবে বলে তাদের ধারণা। যশোর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যশোর বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই। কিন্তু দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর নামে কয়েকশ' ষড়যন্ত্রমূলক ও মিথ্যা মামলা ঝুলছে। তরিকুল ইসলাম, অমিতসহ জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের প্রত্যেকের নামেই রয়েছে হত্যা-নাশকতাসহ ২০-২৫টি করে বিভিন্ন মামলা। এ অবস্থায় কীভাবে নির্বাচনী তৎপরতা চালাবেন তা নিয়ে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় সবাই।
পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৬৫৮ ভোটার অধ্যুষিত যশোর সদর আসনটি আওয়ামী লীগের 'শক্ত ঘাঁটি' হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে গত পাঁচবারের নির্বাচনের মধ্যে চারবারই আসনটিতে বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। শুধু ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী তরিকুল ইসলাম। সংসদ নির্বাচনসহ অন্য নির্বাচনগুলোর ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ আসনে ভোটারদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। ভোটারের এই আধিক্য ও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম আগামী নির্বাচনে 'নৌকা'র বিজয় নিয়ে আসবে বলে দাবি করছেন স্থানীয় নেতারা।
তবে যশোর আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। নেতা-কর্মীরা 'এমপি গ্রুপ' ও 'চাকলাদার গ্রুপ' নামে দুটি ধারায় বিভক্ত। দলীয় সব কর্মসূচিও পালিত হয় পৃথকভাবে। দু'গ্রুপের মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও রয়েছে একাধিক। সদর আসনের বর্তমান সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গ্রুপে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি মোহিত কুমার নাথসহ বেশ কয়েকজন। সদ্য ঘোষিত যুবলীগের শহর ও সদর উপজেলা অ্যাডহক কমিটি সরব এ পক্ষে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহিন চাকলাদারের গ্রুপে সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খয়রাত হোসেন, আবদুল খালেক, যুগ্ম সম্পাদক আলী রায়হান, আবদুল মজিদসহ রয়েছেন জেলা কমিটির কিছু নেতা। জেলা যুবলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের জেলা, উপজেলা ও কলেজ কমিটিগুলোর অবস্থান এ গ্রুপের পক্ষে। সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ এই কোন্দল মেটানো না গেলে ভোটের ফলে 'উল্টো কিছু' ঘটে যেতে পারে।
এদিকে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সদর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা দীর্ঘ হলেও টিকিটপ্রাপ্তির লড়াইটা শেষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে নাবিল ও শাহিনের মধ্যে। আর এ আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী কে হচ্ছেন নিজ দলের চূড়ান্ত বাছাইয়ে এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেবেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত 'ক্লিন ইমেজের' ব্যক্তি হিসেবে নাবিলের পক্ষেই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে দাবি তার অনুসারীদের। তারা বলছেন, যশোরের ছয়টি আসনের এমপিদের মধ্যে নাবিলের বিরুদ্ধে সরকারি বরাদ্দের অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ নেই।
কাজী নাবিল আহমেদ সমকালকে বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি জনগণের জন্য সৎভাবে কাজ করেছেন। বর্তমানে সদরে যে উন্নয়নকাজ হয়েছে, অতীতের কোনো মেয়াদে তা হয়নি। জাতীয় সংসদে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতে দলের জন্য তা আরও ভালো হবে। দলীয় শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে আবারও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
তবে সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, সদরের দু-একটা ইউনিয়নে সোলার প্রকল্প ছাড়া সাংসদের বরাদ্দ টিআর-কাবিখার কোনো কাজ চোখে পড়ে না বেশিরভাগ ইউনিয়নে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরও তিনি গুরুত্ব দেন না।
নাবিলের ঘনিষ্ঠজন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, অনেক অপপ্রচার চলছে, তবে দলীয় সভানেত্রী যাকেই মনোনয়ন দেবেন সবাই তার পক্ষেই কাজ করবে।
দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তির লড়াইয়ে শীর্ষে থাকা নেতাদের অপরজন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার বলেন, ১৭ বছর ধরে দলের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যেমন রাজপথে আছি, তেমনি তৃণমূল ভোটারদের সঙ্গেও রেখেছি নিবিড় যোগাযোগ। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর, গলিপথ সবই আমার মুখস্থ প্রায়। তার মতে, নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তৃণমূলের আস্থার জায়গা কোনটা তিনি তা ভালো করেই জানেন।
শাহিনের বিরুদ্ধেও রয়েছে সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ। তার পক্ষে সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাবে তার ঘনিষ্ঠজন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার খয়রাত হোসেন বলেন, শাহিন চাকলাদারকে সব সময় কাছে পান সাধারণ কর্মী-ভোটাররা। বিএনপির মতো একটা দলকে মোকাবেলায় মানুষের কাছাকাছি থাকা এমন নেতাই হবেন যোগ্য।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, আমিসহ অনেকেই মনোনয়ন চাচ্ছি। তার মানে এই নয় যে, আমরা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছি। বরং আওয়ামী লীগ বড় দল। একাধিক নেতা মনোনয়ন চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত দল যাকে মনোনয়ন দেবে নেতা-কর্মী ও ভোটাররা তাকেই বিজয়ী করবেন। এ ব্যাপারে দলে নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ আছে।
জোটগতভাবে নির্বাচনে নামার পর এ আসনে জামায়াত কখনও প্রার্থী দেয়নি। এবারও তাদের সদর আসনকেন্দ্রিক কোনো তৎপরতা নেই, সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবেও এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি কারও নাম। নিবন্ধন বাতিল, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু ও মামলার চাপে নাজেহাল বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক এই দলটিতে গৃহবিবাদও তুঙ্গে। যশোর জামায়াত নেতৃত্ব এখন ত্রিধাবিভক্ত। তাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিকও কৌশলে এড়িয়ে চলছে দলটিকে। বিএনপির ইফতার পার্টিসহ সাম্প্রতিক কোনো আয়োজনেই দাওয়াত দেওয়া হয়নি জামায়াত নেতাদের।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দুটি দলের দুই শীর্ষ নেতার বাড়ি যশোর সদরে। এই নেতাদের জন্য আসনটি দাবি করবে তাদের নিজ নিজ দল। তারা হলেন_ জাসদের কার্যকরী সভাপতি রবিউল আলম ও ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ইকবাল কবীর জাহিদ। উল্লেখ্য, বামপন্থি এ দল দুটি যশোরের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মাহবুব আলম বাচ্চু ও জেলা সভাপতি শরিফুল ইসলাম সরু চৌধুরী দলের মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে যশোরে জাপার তেমন কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। নির্বাচনকে ঘিরেও তাদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
No comments: