ঈশ্বরকে খুঁজে পাইনি ক্যাথলিক ধর্মে, এমনটিই বললেন ইসলামে দীক্ষিত আইরিশ নারী ব্রিগিড এলওয়ার্ড।
আইরিশ নারী ব্রিগিড এলওয়ার্ড। তিনি দেশটির ওয়াটারফোর্ড ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের একজন পেডিয়াট্রিক নার্স। তিনি বেড়ে ওঠেছেন একজন খ্রিস্টান হিসেবে। কিন্তু বাইবেলের অর্থ তার মাঝে ঈশ্বরের পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি।
খ্রিস্ট ধর্ম তার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে তিনি তার বাড়ি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কেবলই ভাবতে থাকেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন এবং তার এ পৃথিবীতে আসার মূল উদ্দেশ্য কী।
ব্রিগিড বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতাম ঈশ্বর আছে কিন্তু আমি ক্যাথলিক ধর্মে ঈশ্বরকে খুঁজে পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি ক্যাথলিক ধর্ম পালন না করলেও আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু সেখানে আমার উদ্দেশ্যের উপাদান প্রয়োজন ছিল। আমি বাইবেল পড়া শুরু করি এবং আমার কাছে কেবল অনুভূত হতো, এতে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তিনি তার বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে মুক্তি লাভের আশায় একটি মুসলিম দেশে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন; যেখানে তিনি একজন নার্স হিসাবে কাজের পাশাপাশি ঈশ্বরের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন এবং তার বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেন।
ব্রিগিড বলেন, ‘নিজের বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে মুক্তি পেতে আমি সৌদি আরব যাই। সেখানে গিয়ে আমি বুঝলাম, আমার মানসিকতা, আমার সংস্কৃতি খুব বেশি পশ্চিমা গড়নের। আমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। সেখানে হিজাব পরিহিত নারীদের দেখে হতাশ প্রকাশ করতাম। আমি ভেবেছিলাম মাথা ঢেকে রাখা এই নারীরা মনে হয় অনেক কষ্টের জীবন জীবন যাপন করছে এবং সমাজের মধ্যে তাদের কোনো স্থান নেই।’
‘পর্দার অন্তরালের মায়েরা’
ব্রিগিড জানান, একটি মুসলিম দেশে একজন পেডিয়াট্রিক নার্স হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তিনি ‘পর্দার অন্তরাল মায়েদের’ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এটি পর্দা সম্পর্কে তার কাল্পনিক ধারণা দূর করে দেয়। তিনি বলেন, ‘অনেকে তারা হিজাব পরিধান করেন না, এটা তাদের পছন্দ। তারা মানুষ।তারা স্বাভাবিক। ইসলামকে ভালভাবে জানতে ও বুঝতে আমি এসম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করি এবং এইসব মহিলাদের ভালোভাবে বুঝতে শুরু করি।’
২০০৮ সালের নভেম্বরে ব্রিগিড ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে অন্য সবার মতো তার মনে কিছু ভয় কাজ করছিল। তার মা কিংবা তার পরিবারের অন্য সদস্যরা তার ইসলামে ধর্মান্তরকে কিভাবে গ্রহণ করবেন তা নিয়ে তার মনেও ভয় ছিল।
সৌদিতে হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে সেখানে এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্রিগিডের মনের ভয় দূর করতে তার স্বামী এগিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিক্রিয়া ছিল সবসময়ই ইতিবাচক। আমি জানতাম একটি বড় পরিবর্তনে মানুষ বিস্মিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার কেবল সৌন্দর্য্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে; যা আয়ারল্যান্ডের মহান উদ্দীপনা।’
ব্রিগিড জানান, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের ভ্রমণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার খবর তাকে খুবই মনঃকষ্ট দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের নিয়ে ট্রাম্প যা করেছে তা খুবই হতাশাজনক। ট্রাম্পের মতো মানুষদের নিয়ে আমাদের ভয়ের কারণ আছে এবং আমরা এই ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে কাজ করছি। তার কর্মকাণ্ড আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।’
মুসলমানদের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা
ড. রিচেল উডলক একজন অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম নারী ও শিক্ষাবিদ। তিনি বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের ‘ক্লোনমেল’ শহরে বসবাস করছেন। তিনি মুসলমানদের মনোভাব ও তাদের মতামত সম্পর্কে অধ্যয়নরত আছেন। তিনি জানান, ইসলাম নিয়ে সেখানে অনেক ভ্রান্ত ধারনা আছে। তাদের একটি হচ্ছে- সকল মুসলমান আসলেই ধর্মপ্রাণ নয়।
তিনি বলেন, ‘ক্যাথলিক ধর্ম হচ্ছে আপনাকে ইস্টার সানডেতে রোজা পালন করতে হবে কিন্তু সব ক্যাথলিক রোজা পালন করেন না এবং সব ক্যাথলিক চার্চেও যান না এবং ইসলামেও ব্যাপারটি অনেকটা একই রকম।’
উডলক বলেন,’অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার মুসলিম জনসংখ্যার ‘ধর্মপ্রীতির’ হার সাধারণ জনগোষ্ঠীর মতো একই। সেখানে কিছু মুসলিম মসজিদে যান। একইভাবে কিছু খ্রিস্টান ক্রিসমাসের সময়ে চার্চে যান। উডলক জানান, সেখানে একটি ক্যাফেতে হামলা চালানোর আগে সেখানে ইসলাম সম্পর্কে ভিন্ন মনোভাব ছিল। ওই ঘটনার পর নিউ সাউথ ওয়েলসের মত অনেক রাজ্যে জাতিগত বলপ্রয়োগ শুরু হয়। অন্যদিকে, ভিক্টোরিয়া রাজ্যে একটি ‘বহুসাংস্কৃতিক লিয়াজোঁ ইউনিট’ গঠন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘যদিও আক্রমণকারী সম্পর্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘লোকটি ছির উন্মাদ। আমরা তার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন এবং তিনি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেন না।’ চলতি সপ্তাহে কানাডার কুইবেকের একটি মসজিদে হামলায় জড়িত আক্রমণকারীকে ‘নির্জন নেকড়ে’ বলে ডাকা হচ্ছে। ঠিক আছে ‘হেরন মনিস’ নামের ওই ব্যক্তি আমাদের জন্য একিট ‘নির্জন নেকড়ে’। তিনি জানান, আয়ারল্যান্ডের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানরা অনেক ভিন্নতা অনুভব করেন।
তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ মুসলমান কিন্তু সেখানে তারা মিডিয়া কাভারেজ পায় ৩০-৪০ শতাংশ। অন্যদিকে, আয়ারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ মুসলিম এবং তারা প্রায় ৫০ শতাংশ মিডিয়া কাভারেজ পেয়ে থাকে।’
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘পর্দার’ ব্যবহার
ঐতিহ্যগতভাবেই মুসলিম সংস্কৃতিতে পুরুষ এবং নারীদের উভয়ে তাদের শরীর ঢেকে রাখেন। পরবর্তীতে এটি বিবর্তিত হয় যে, এটি কেবল উপরতলার নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তারপর ১৮শ’ শতাব্দীতে সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে এটি সব পরিবারদের মধ্যে প্রচলিত হয়। নারীর মুক্তির জন্য ‘ইউরোপীয়দের আহ্বান সম্পর্কে উডলক বলছেন, ‘কি হাস্যকরভাবে ইংল্যান্ডের লর্ড ‘ক্রোমারের’ মতো লোকেরা যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন যে, এই নারীদের মুক্ত করা প্রয়োজন। আবার তারাই নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেরও বিরোধিতা করেছে।’
অটোমান সাম্রাজ্য নারীরা মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করেছে। হিজাবকে তখন প্রতিরক্ষার শেষ বাধা হিসেবে দেখা হয়েছে। তাই পর্দা বর্তমানে একটি রাজনৈতিক স্রোত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে; যা পূর্ববর্তী যুগে ছিল না।
এমনকি ফ্রান্সে বোরকিনি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের ভয় মোকাবেলার উপায় হিসেবে এটি নিষিদ্ধ করায় তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং সাম্প্রতিক সুইস হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে যে, মুসলমান মেয়েদের তাদের শিক্ষার অংশ হিসেবে অবশ্যই ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা শিখতে হবে।
উডলক বলেন, ‘পশ্চিমা অধিকাংশ মুসলিম নারী তাদের পরিচয়ের অংশ হিসাবে পর্দাকে বেছে নিয়েছে। মৌলবাদী কর্মের অংশ হিসেবে নয়।’
ব্রিগিড বলেন, ‘এরাই হচ্ছে নারী, যারা হিজাব পরতে চায়। এটি পরিধান করার মাধ্যমে আপনি এর প্রকৃত সুবিধা উপলব্ধি করতে পারবেন।’ বিগ্রিড আরও বলেন, ‘হিজাব পরার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা পূরণের পাশাপাশি এটি আমার মনে অধিক আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। আমি যখন লোকেদের সঙ্গে কথা বলি, তখন তারা আমার চুল ভালো না খারাপ তা দেখতে পায় না এবং যা আমার ভেতরের আস্থাকে মজবুত করেছে।’
উডলক প্রতিদিনই হিজাব পরেন। তিনি বলেন, ‘নারীরা কেন হিজাব পরিধান করেন তা কয়েকটি মুসলিম দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে গভীরভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছি।’তিনি আরও বলেন, ‘সত্যি বলতে আমি এর মাধ্যমে আমি আমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার ধারনা পেয়েছি। আমি এর মাধ্যমে কোনরকম বাধা ছাড়াই বিশ্বকে দেখতে সক্ষম হয়েছি।’
‘বিশ্ব হিজাব দিবস’ উপলক্ষে গত বুধবার আয়ারল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ড ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্য নারীদের মতো ব্রিগিড এলওয়ার্ড ও উডলকও অংশ নেন।
মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে কুসংস্কার এবং বৈষম্য বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে নাজমা খান নামে নিউইয়র্ক প্রবাসী একজন বাংলাদেশি নারী এর প্রচলন করেন।
সূত্রঃ অনলাইন।
No comments: